মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১

এখনই নির্বাচনে ‘না’ ছাত্র-জনতার

এখনই নির্বাচনে ‘না’ ছাত্র-জনতার

সংগৃহীত

শহিদের রক্তে অর্জিত নতুন বাংলাদেশের পুরোপুরি সংস্কার না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনে সায় নেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার। বরং তাড়াহুড়ো না করে রাজনৈতিক দলগুলোকে সংস্কারের তাগিদ দেন তারা। রাষ্ট্র সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকারকে আপাতত এক বছর সময় বেঁধে দিতে চান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সংগঠনটির শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক সমন্বয়ক যুগান্তরকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান। এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের টানা প্রায় ১৬ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। বিজয় উল্লাসে মেতে উঠেন ছাত্র-জনতা। এর পাশাপাশি বেদনায় ভারাক্রান্ত হয় জাতি। চারদিক থেকে খবর আসতে থাকে তৎকালীন সরকারের নির্দেশে আন্দোলন দমনের নামে পুলিশ ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ চালিয়েছে। 

এতে রাজপথ থেকে শুরু করে বাড়ির ছাদ ও বারান্দায় দাঁড়ানো শিশুসহ শত শত মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন হাজার হাজার আন্দোলনকারী। হাসপাতালগুলোতে লাশের স্তূপ। স্বজন হারানোর শোকে বিজয়ের আনন্দ ম্লান হয়ে যায়। আন্দোলনের একপর্যায়ে ছাত্র-জনতা সরকারের পদত্যাগে একদফা দাবি ঘোষণা করেন। শত শত মানুষ হত্যার পরও আন্দোলন দমনে ব্যর্থ হয়ে সরকার অবশেষে পদত্যাগ করে পালিয়ে যায়। 

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের ৩ দিন পর ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এই সরকারে স্থান করে নেন ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়ক। এছাড়া আন্দোলনের অন্য সমন্বয়করা এখনও রাজপথে ছাত্র-জনতার নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। তারাই দাবি জানিয়েছেন এখনই নির্বাচন নয়। রাষ্ট্র সংস্কারের পর নির্বাচন করতে হবে। এ সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে সংস্কারের জন্য নেতাদের পরামর্শ দেন তারা। 

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা মন্তব্য করেন, রাষ্ট্র সংস্কার না করে কোনো নির্বাচন নয়। তারা বলেন, যে উদ্দেশ্যে ছাত্র-জনতার বিজয় হয়েছে আগে সেগুলো বাস্তবায়ন হতে হবে। দেশের আমূল সংস্কার করতে হবে। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরে রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনিয়ম-দুর্নীতি ঢুকে পড়েছে। এসব নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন নয়। রাষ্ট্র সংস্কারের পর দেশের মানুষ তাদের কাঙ্ক্ষিত সরকার পাবে বলেও মনে করেন তারা। 

এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অথরাইজেশন উইংয়ের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচনের জন্য রাষ্ট্র সংস্কার গুরুত্বপূর্ণ। নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনই শুধু পারে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দিতে। তিনি বলেন, নির্বাচনের জন্য যেমন নির্বাচন কমিশন সংস্কার প্রয়োজন তেমনি রাষ্ট্রের জন্য রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান সংস্কার প্রয়োজন। ছাত্র-জনতার সরকার সে কাজটিই করছে। 

সারজিস আলম বলেন, রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে। কিছু সংস্কার প্রক্রিয়াধীন। আমরা রাষ্ট্র সংস্কারে ১ বছর সময় দিতে চাই। দেখি এতে কতটুকু সংস্কার হলো। যদি সম্পূর্ণ না হয় তবে তা রাষ্ট্র সংস্কারের স্পিরিটের সঙ্গে কতটা সামঞ্জ্যপূর্ণ তা যাচাই করে পরবর্তী করণীয় ঠিক করব। 

‘রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারের পরই জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক’-মন্তব্য করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অথরাইজেশন উইংয়ের আরেক সমন্বয়ক বাকের মজুমদার বৃহস্পতিবার রাতে যুগান্তরকে বলেন, ইতোমধ্যে আমরা এ নিয়ে সরকারের বিভিন্ন মহলে কথা বলেছি। সেখান থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজও শুরু হয়েছে। এর জন্য সময় লাগবে। আমাদের সময় দিতে হবে। সময় এবং ধৈর্যের ফল সুমিষ্ট হয়। 

সংগঠনটির মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন উইংয়ের সমন্বয়ক রিজওয়ান আহমেদ রিফাত যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচন কখন হবে সেই সিদ্ধান্ত দেওয়ার এখতিয়ার একমাত্র ছাত্র-জনতার। আমাদের সেই ম্যান্ডেড দিয়েছেন তারা। ছাত্র-জনতা এখনি নির্বাচন চায় না। তিনি বলেন, নির্বাচন প্রয়োজন কিন্তু সেটা এখনই নয়। 

বিগত ১৫ বছরে ফ্যাসিস্ট সরকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও আমলাতন্ত্রকে ব্যবহার করে নির্বাচন ব্যবস্থাকে সমূলে ধ্বংস করেছে। এই ভেঙে পড়া নির্বাচনি ব্যবস্থাকে আমূল সংস্কার না করে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। মূলত সে কারণেই আমরা এখন নির্বাচন নয়, রাষ্ট্র সংস্কারের দিকে হাঁটছি। প্রয়োজনীয় রাষ্ট্র সংস্কারের পর অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে। 

রিফাত বলেন, যারা নির্বাচন চাইছেন, সরকারকে এ নিয়ে ডেটলাইন দিচ্ছেন তাদের উচিত জনমতের দিকে নজর দেওয়া, রাষ্ট্রীয় সংস্কারে সহযোগিতা করা। রাষ্ট্র সংস্কার করে যৌক্তিক সময়েই নির্বাচন হবে বলেও মনে করেন তিনি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অরগানাইজিং উইংয়ের আবদুল হান্নান মাসুদ বলেন, রাষ্ট্র সংস্কার শুধু একটা রাষ্ট্র সংস্কার না। এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ সংস্কার না হলে কোনো সংস্কারই টিকবে না। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নিজেদের সংস্কার যত দ্রুত করতে পারবে তত দ্রুত নির্বাচনি পরিবেশ সৃষ্টি হবে। এরজন্য আমরা যেমন ডেটলাইন দিতে পারি না, তেমনি দলগুলোও অন্তর্বর্তী সরকারকে সময় মেপে দিতে পারে না। রাষ্ট্রকে পুরোপুরি সুস্থ করেই নির্বাচন হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
 
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, যারা দ্রুত নির্বাচন চান তারা রাষ্ট্র সংস্কার চান না। আমরা তাদের উদ্দেশে বলব, রাষ্ট্র সংস্কারের পাশাপাশি আপনারা নিজেদের বদলে ফেলুন, দলের সংস্কার করুন। এটাও রাষ্ট্র সংস্কারের পার্ট। রাষ্ট্রের সংস্কারের আগে কোনো নির্বাচন নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি। 

ইতোমধ্যে রাষ্ট্র সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। রাজনৈতিক দলের অধিকাংশ নেতা সংস্কারের পর নির্বাচনের কথা বললেও কিছু নেতা দ্রুত নির্বাচন প্রসঙ্গে বলেন। এ নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষ সমন্বয়করা সংস্কার নিয়ে নানা রূপরেখা দেন। তারা বিভিন্ন কর্মসূচিতে সংস্কার রূপরেখা তুলে ধরে বক্তব্য দিয়ে জনগণকে সচেতন করেন। 

এদিকে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের এক মাস পূর্তিতে বৃহস্পতিবার রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বিশাল জনসমাগম করে ‘শহিদি মার্চ’ কর্মসূচি পালন করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এ কর্মসূচি থেকে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের রোডম্যাপ দ্রুত ঘোষণাসহ ৫ দফা দাবি জানিয়েছেন সমন্বয়করা। এদিন পদত্যাগ করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। 

গত জুলাইয়ের শুরুতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। ওই আন্দোলন দমনে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সংগঠন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হামলা-নির্যাতনের একপর্যায়ে তা সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। কোটা সংস্কার আন্দোলন দমন করতে সরকারি নির্দেশে গুলি করে মারা হয় শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষদের। একপর্যায়ে ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। যার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের টানা প্রায় ১৬ বছরের শাসনামলের অবসান ঘটে।

সূত্র: কালের কণ্ঠ

সর্বশেষ: